মুহূর্তের সিদ্ধান্ত !


মিথিলা (ছদ্মনাম) যে বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা অফিসের সহকর্মীরা খেয়াল করলেও কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। কর্মঠ মেয়েটি তিন-চার মাস ধরেই কাজে অনিয়মিত। প্রায়ই চেহারায় দেখা যায় অন্যমনস্কতা ও বিষণ্নতা।
সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলেও বেশ অনেক দিন ধরেই নিজেকে যেন গুটিয়ে রেখেছিলেন। ওর মুখে ‘জীবনের অর্থহীনতা’, ‘বেঁচে থেকে কী লাভ’—এ ধরনের কথা শুনে একটু অবাক হলেও সহকর্মীরা বিষয়টি তেমন পাত্তা দেননি। কিন্তু সবাইকে হকচকিত করে হঠাৎ একদিন সবার প্রিয় মিথিলা আত্মহত্যা করে বসেন।
এ ঘটনায় মিথিলার সহকর্মী এক মেয়ের মনে হয় নিজের গল্প। একসময়ে দিশেহারা হয়ে তিনিও আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। সে সময় তাঁরই এক বন্ধু জীবন শেষ করার পরিবর্তে যতটুকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়ে সাহস করে ঘুরে দাঁড়াতে বলেন। ২০ বছর আগে যে জীবন তিনি শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলেন, সে জীবনে পরবর্তী সময়ে এসেছে আনন্দ, নিজের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, জেনেছে নিজের অসীম শক্তিমত্তা। মিথিলার সঙ্গে একটু কথা বললে কি বদলে দেওয়া যেত এ ঘটনা?
আত্মহত্যা একটা আত্মধংসী সিদ্ধান্ত। যা ঘটে গেলে সে জীবনে ফিরে পাওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আপনার একটি মিনিট, একটি জীবন বদলে দিতে পারে’।
যদিও সম্পর্কজনিত জটিলতা, যেকোনো ব্যর্থতা (প্রেমে প্রত্যাখ্যান, বিচ্ছেদ, পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, আকস্মিকভাবে সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন), কষ্টকর শারীরিক রোগ ইত্যাদি নানা কারণে অনেকে আত্মহত্যা করলেও এ রকম আত্মধ্বংসী প্রতিক্রিয়া কখনোই স্বাভাবিক নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহননকারী মানুষদের মধ্যে কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা থাকে, যেগুলোর মধ্যে বিষণ্নতা রোগ অন্যতম।

আত্মহত্যা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা

* আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বললে আত্মহত্যার প্রবণতাকে উসকে দেওয়া হয়।
* যারা মুখে আত্মহত্যার কথা বলে বা হুমকি দেয়, তারা কখনোই আত্মহত্যা করবে না।
* আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি পুনরাবৃত্তি করবে না।
* যারা আত্মহত্যা করে ফেলে, তারা কোনোভাবেই অন্যকে জানায় না বা কোনো সতর্কসংকেত রাখে না।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা

* যেকোনো সতর্কসংকেত পরিবারের কারও মধ্যে দেখা গেলে দেরি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে পরামর্শের জন্য যান। মানসিক কষ্ট নিরসনের মাধ্যমে আত্মহত্যা সম্পূর্ণ সমাধানযোগ্য।
* আত্মহত্যার হুমকিকে শুধু মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা না ভেবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিন। গবেষণায় দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি আত্মহত্যার আগে এটি নিয়ে কথা বলেছেন এবং এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুনির্দিষ্টভাবে আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা বলেছেন।
* আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা গুরুত্ব দিয়ে বলুন এবং সরাসরি জিজ্ঞাসা করুন (তোমার কি আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসছে বা এমন কষ্ট হচ্ছে যে বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছা হচ্ছে না?)।
* আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে একা না রাখা
* আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির হাতের কাছে ছুরি, কাঁচি, ওষুধ, কীটনাশক, পোকা মাড়ার বিষ না রাখা।

আত্মহত্যার চিন্তা এলে কী করবেন?

* মনে রাখুন, বর্তমানের খারাপ সময়ও চিরস্থায়ী নয়। আত্মহত্যার মতো চিন্তা এলে ‘থামুন, নিজেকে আরেকবার সুযোগ দিন।’
* আপনার বর্তমান সমস্যা সমাধানে বা আপনার মানসিক কষ্ট কমানোর জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
* মনের কষ্ট প্রকাশ করুন কোনো প্রিয়জন বা আস্থাভাজন কারও সঙ্গে। তাঁর সাহায্য চান।
* যেসব নেতিবাচক চিন্তা আপনাকে আচ্ছন্ন করে আছে, সেসব পাশ কাটিয়ে আপনার জীবনের ইতিবাচক বিষয়গুলোর দিকে তাকান (যেমন বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের যারা আপনাকে ভালোবাসে, শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদি)।
* আপনার সমস্যা সমাধানের যে পথ ব্যর্থ হয়েছে, সেটা না ঘেঁটে বিকল্প পথগুলোর কথা চিন্তা করুন।
* আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে এক মিনিট হলেও একবার ভাবুন, জীবনকে একবার সুযোগ দিন। এটা নিশ্চিত, জীবন আপনাকে ঠকাবে না।

আত্মহত্যার সতর্কসংকেত

* যেকোনো সুইসাইড নোট
* সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আত্মহত্যার কথা বলা বা হুমকি
* এক বা কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা
* বিষণ্নতা রোগ
* নানা কাজে আত্মহত্যার কথা প্রকাশ করা (যেমন লেখা, ছবি, গান, কথা ইত্যাদির মাধ্যমে)
* বড় ধরনের অপরাধবোধ, নিজের প্রতি ধিক্কার প্রকাশ
* ব্যাখ্যাতীত আচরণ
* অনেক দিন ধরে ঘুমের ওষুধ জমিয়ে রাখা
* হঠাৎ উইল করে ফেলা
* পছন্দের জিনিসপত্র অন্যকে দান করে দেওয়া
* হঠাৎ সবার কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা
* প্রিয়জনের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ইত্যাদি

মেখলা সরকার
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
সঙ্কলনঃ- প্রথম আলো 

No comments:

Post a Comment