এক গ্রাম মরিচের দাম তিন লাখ টাকা !

মরিচটির নাম গিনেজ বুকে উঠেছে আগেই। এখন বলা হচ্ছে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মরিচ উৎপাদন করে আড়াই হাজার কোটি টাকার বাজেট মোকাবেলা করাও সম্ভব! এক গ্রাম মরিচের দাম যদি হয় তিন লাখ টাকা, তাহলে সেটা অসম্ভব কিছু নয়

সোনার চেয়ে দামি এ মরিচের নাম নাগা মরিচ। ইংরেজিতে ক্যাপসাইসিন। আর সবচেয়ে আশার বিষয়, মরিচটির স্বত্ত্ব একমাত্র বাংলাদেশের। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর, জ্বালাময়ী ‘পিপার স্প্রে এই মরিচের ক্যাপসাইসিন নামক একটি রাসায়নিক ও ইউভি ডাই (UV dye) থেকে উৎপন্ন ঝাঁঝালো গ্যাস। মরিচের ক্যাপসাইসিন এ ধরনের অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু এর সফল ব্যবহার মানব সভ্যতার জন্য কল্যাণকর।
প্রাকৃতিক ক্যাপসাইসিন যৌগ থেকে এন্টি ক্যান্সার ওষুধ, ব্যথা নির্মূল, ওজন ঠিক রাখা প্রভৃতির ওষুধ তৈরি হয়। যে কারণে ক্যাপসাইসিন খুবই মূল্যবান একটি মরিচ। এর এক গ্রামের দাম তিন লাখ টাকার অধিক।
বগুড়া মসলা গবেষণা ইন্সটিটিউটে কর্মরত বৈজ্ঞানিক মাছুদুল হক ঝন্টু এসব বিষয় নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে জানান, আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে মরিচকে পিপার (Pepper) বা চিলি পিপার (Chilli Pepper) বলা হয়। এই মরিচ বা চিলি পিপার হলো ক্যাপসিকাসট্রাম (Capsicastrum) নামের অতি বিষাক্ত গাছের নিকটাত্মীয়, যা নাইটসেড বা সোলানেসিয়া (Solanacea) পরিবারভ‍ুক্ত একটি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ।
তিনি আরও জানান, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৮০০ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রথম মরিচের চাষ শুরু হয়। সেখানে ইনকা নামক জাতিগোষ্ঠী মরিচকে দারুণ দাম দিতো। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও এটিকে ব্যবহার করতো। এমনকি এক সময় এরা এই মরিচকে মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহার করতো। কলম্বাস পঞ্চদশ শতাব্দীতে মরিচ ইউরোপে নিয়ে আসেন। তারপর পর্তুগিজরা এটাকে ভারত ও আফ্রিকায় তাদের বিভিন্ন বাণিজ্যিকীকরণ করেন। এরপর জনপ্রিয়তা পাওয়ায় অধিকাংশ দেশেই ব্যাপকহারে মরিচ চাষ শুরু হয়।
উদ্ভিদ নিঃসৃত সবচেয়ে শক্তিশালী বিষাক্ত পদার্থের মধ্যে এটি অন্যতম। পৃথিবী সৃষ্টির উষালগ্নে এই ঝাল বিষের কারণেই তোতা ছাড়া অন্য প্রাণী এটা খেতে ভয় পেতো। এর অপব্যবহারে ফলে মানুষের ত্বকে লাগলে আগুনে পোড়ার মতো প্রচণ্ড জ্বালা-পোড়া তৈরি করে, চোখে লাগলে জ্বালা-পোড়া সৃষ্টি হয়ে চোখে পানি চলে আসে, এমনকি সাময়িক অন্ধত্বও দেখা দিতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাঁচ সেন্টিমিটার লম্বা পোড়াটে হলুদ রঙের 'ভুত জলোকিয়া' (বাংলায় যা ভুত মরিচ হিসেবে পরিচিত) দেশটির সেনা শহর তেজপুরের ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঝালের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে বসলে ২০০৫ সালে ঝালের তীব্রতা পরীক্ষা করতে রাজি হয় নিউ মেক্সিকো চিলি পিপার ইনস্টিটিউট। ফলাফলও আসে অবিশ্বাস্য। ৮ লাখ ৫৫ হাজার এসএইচইউ।
তেজপুরের ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরির পরিচালক আরবী শ্রীবাস্তদবা টাইম ম্যাগাজিনকে জানান, ভুত জলোকিয়া (Vhut jolokia) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় হওয়ায় মরিচের রাজা বলা হয় এটাকে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মরিচকে ঘিরে উৎসবও হয়। দাঙ্গার সময় এটা ছড়িয়ে দিলে এক কিলোমিটার অঞ্চলে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে সৈন্যদের একটি খাইয়ে দিলে দ্বিগুণ তেজে যুদ্ধ করবে।
তবে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে বাংলাদেশের নাগা মরিচ। এটি বাংলাদেশ ও নিকটবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের আসাম রাজ্যের ইন্টার স্পেসিফিক হাইব্রিড বা মিশ্র প্রজাতির এক উচ্চ মাত্রার ক্যাসাইসিন যৌগ সমৃদ্ধ মরিচ। জন্মস্থান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ছাড়াও ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও শ্রীলঙ্কার কিছু গ্রামাঞ্চল। যেখানে এটি নাই মিররিস: কোবরা চিলি (Nai Mirris: Cobra Chilli) নামে পরিচিত। তবে উৎপাদিত বৃহত্তর সিলেটের নাগা মরিচ এখন যুক্তরাজ্যের লন্ডন সিটির বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোতে পাওয়া যায়।
২০০৭ সালে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড নাগা মরিচকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা ট্যাবাসকো সস (Tabasco sauce) থেকে ৪০১.৫ গুণ বেশি ঝাল। বেশ কিছুদিন যাবৎ ভারত এ মরিচ তাদের বলে দাবি করলেও নাগা মরিচের সত্ত্বাধিকার একমাত্র বাংলাদেশের।
মসলা গবেষণা ইন্সটিটিউট বগুড়ার পরিচালক (পরিকল্পনা ও ম‍ূল্যায়ন) ড. ভাগ্য রানী বণিক বাংলানিউজকে জানান, সম্প্রতি ক্যাপসাইসিন প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য একটি মেশিন তারা পেয়েছেন। তবে প্রশিক্ষিত বৈজ্ঞানিক ছাড়া এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন। সরকারের যত্নশীল, গুরুত্বপূর্ণ নজরদারি থাকলে ক্যাপসাইসিন দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি লাভবান হতে পারবে।
সরকারও এ মরিচ বিষয়ে নজর দেবে, আরও যত্নশীল হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments:

Post a Comment